বৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলামে বিধি-নিষেধ নেই। সম্পদের শুদ্ধতার জন্য জাকাত প্রদানের নিয়তে যে কেউ প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে। কিন্তু অর্থের নেশায় বিভোর হয়ে অবৈধপথে সম্পদ উপার্জন আমাদের পরকালীন জীবনে ক্ষতির পাশাপাশি পার্থিব জীবনও সংকটময় করে তোলে।

তাই লোভনীয় অফার ও অল্প দিনে বেশি অর্থ উপার্জনের নানা ধরনের ব্যবসায়ী ফাঁক-ফন্দি এড়িয়ে বৈধ পন্থা অবলম্বন করা জরুরি। কারণ যুগে যুগে যাঁরাই অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য, হারাম উপার্জন ও লোভনীয় অফারে যুক্ত ছিলেন প্রত্যেকেই প্রতারিত, ধ্বংস ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এক মজলিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সম্পর্কে ভয় করি না যে তোমরা আমার পরে শিরকে লিপ্ত হবে।

তবে আমি তোমাদের সম্পর্কে দুনিয়াকে ভয় করি যে তা অর্জনের প্রতিযোগিতায় তোমরা জড়িয়ে পড়বে এবং হানাহানি করবে। ফলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৮৭১) আরেক হাদিসে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে এসেছে, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-কে বাহরাইনে জিজিয়া বা কর আদায় করতে পাঠিয়েছেন।

তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বাহরাইনবাসীদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন এবং তাদের জন্য আলা ইবনে আলহাজরামি (রা.)-কে শাসনকর্তা নিয়োজিত করেছিলেন। এরপর আবু উবাইদা (রা.) বাহরাইন থেকে ধন-সম্পদ নিয়ে এলে আনসার সহাবারা তাঁর আগমনের সংবাদ শোনে, তারপর তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ফজরের সালাত আদায় করে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাত আদায়ের পর মুখ ফিরিয়ে বসেন। তারা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দেখে মুচকি হেসে বলেন, আমার মনে হচ্ছে আবু উবাইদা (রা.) বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে, এ সংবাদ তোমরা শুনেছ? তারা বলে, জি হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)।

তিনি বলেন, তাহলে তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, যা তোমাদের খুশি করবে বলে আশা রাখো। আল্লাহর শপথ! তোমাদের ওপর দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনের আশঙ্কা আমি করি না। আমি তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে তোমাদের ওপর প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য ঢেলে দেওয়া হবে, যেভাবে পূর্ববর্তীদের ওপরও প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য ঢেলে দেওয়া হয়েছিল।

অতঃপর তোমরা তেমনি প্রতিযোগিতা করবে, যেমন তারা প্রতিযোগিতা করেছে। পরিশেষে তোমাদেরও ধ্বংস করে দেবে, যেভাবে তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ৭৩১৫)। তবে সৎ পন্থায় অর্থ উপার্জন করলে আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন আর অবৈধ উপার্জনে বরকত নষ্ট করে দেন। বিষয়টি সহজে বোঝাতে রাসুল (সা.) একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘হে লোকসকল, আল্লাহর শপথ! তোমাদের ব্যাপারে আমার কোনো কিছুর আশঙ্কা নেই।

তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পার্থিব সৌন্দর্য ও চাকচিক্যের ব্যবস্থা করে রেখেছেন, এ সম্পর্কে তোমাদের ব্যাপারে আমার আশঙ্কা আছে। এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, কল্যাণের পরিণামে কি অকল্যাণও হয়ে থাকে? রাসুলুল্লাহ (সা.) কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী বলেছিলে? সে বলল, আমি বলেছিলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, কল্যাণের সঙ্গে কি অকল্যাণ আসবে?’

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে লক্ষ্য করে বলেন, কল্যাণ তো অকল্যাণ বয়ে আনে না। তবে কথা হলো, বসন্তকালে যেসব তৃণলতা ও সবুজ ঘাস উৎপন্ন হয়, এটা কোনো পশুকে ডায়রিয়ার প্রকোপে ফেলে না বা মৃত্যুর কাছাকাছিও নিয়ে যায় না। কিন্তু চারণভূমিতে বিচরণকারী পশুরা এগুলো খেয়ে পেট ফুলিয়ে ফেলে। অতঃপর সূর্যের দিকে তাকিয়ে পেশাব-পায়খানা করতে থাকে, অতঃপর জাবর কাটতে থাকে। এগুলো পুনরায় চারণভূমিতে যায় এবং এভাবে অত্যধিক খেতে খেতে একদিন মৃত্যুর শিকার হয়।

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে তাকে এর মধ্যে বরকত দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি অসৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে সে অনেক খাচ্ছে; কিন্তু পরিতৃপ্ত হতে পারছে না। (মুসলিম, হাদিস : ২৩১১)। তা ছাড়া যারা হারাম পন্থায় উপার্জন করে, মহান আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধূলিমলিন।

সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার প্রভু, হে আমার প্রতিপালক, অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এ অবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৮৯)। তাই তো পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ হালাল উপার্জনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনরা, আহার করো আমি

তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর করো, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭২)। অতএব লোভনীয় অফার ও অল্প দিনে বেশি অর্থ উপার্জনের নেশা পরিহার করে দীর্ঘ মেয়াদের হলেও বৈধ পন্থা অবলম্বন করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৎ পথে অর্থ উপার্জনের তাওফিক দান করুন।